শীতকালে মুরগির যত্ন – মুরগি পালন
ভূমিকা
বাংলাদেশে শীতকাল সাধারণত নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত থাকে। এই সময় তাপমাত্রার পরিবর্তনের কারণে মুরগির খাদ্যগ্রহণ, ডিম উৎপাদন, ওজন বৃদ্ধি এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতায় উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়ে। তাই খামারিরা এ সময়ে মুরগির বিশেষ যত্ন নিতে বাধ্য হন। শীতকালে মুরগিকে স্বাস্থ্যকর রাখার পাশাপাশি উৎপাদনশীলতা বজায় রাখতে কিছু কার্যকরী পদ্ধতি অনুসরণ করা প্রয়োজন।
খামারের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ
শীতকালে মুরগির জন্য সঠিক তাপমাত্রা বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। মুরগির জন্য আদর্শ তাপমাত্রা ২০-২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপমাত্রা কমে গেলে মুরগির শরীরে শক্তির ঘাটতি দেখা দেয়, যা তাদের স্বাস্থ্যহানি করে। খামারে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য নিচের পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করা যেতে পারে:
- গরম বাতাস সরবরাহ: খামারে গ্যাস হিটার বা ইনফ্রারেড বাল্ব ব্যবহার করে তাপমাত্রা ঠিক রাখা যায়। এগুলো মুরগির শারীরিক গরমের ঘাটতি পূরণে সহায়ক।
- নির্ধারিত তাপমাত্রা বজায় রাখা: খামারের ভিতরে তাপমাত্রা মনিটর করার জন্য থার্মোমিটার ব্যবহার করা উচিত। তাপমাত্রা কমে গেলে হিটিং সিস্টেম চালু করা উচিত।
- বায়ু চলাচল নিয়ন্ত্রণ: শীতকালে ঠান্ডা বাতাস প্রবেশ ঠেকাতে দরজা ও জানালা সঠিকভাবে বন্ধ রাখতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, পর্যাপ্ত বায়ু চলাচল বজায় থাকে যেন খামার স্যাঁতসেঁতে না হয়।
খাদ্য ও পানির ব্যবস্থা
শীতকালে মুরগির খাদ্য ও পানির বিশেষ ব্যবস্থা করতে হয়, কারণ ঠান্ডায় মুরগির শক্তির চাহিদা বেড়ে যায়। তাদের শরীরের উষ্ণতা বজায় রাখতে বেশি শক্তি প্রয়োজন হয়, তাই খাদ্যের পরিমাণ ও মান বাড়ানো জরুরি।
- উচ্চ পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাদ্য: শীতকালে মুরগির খাদ্যতালিকায় বেশি প্রোটিন এবং ক্যালোরিযুক্ত খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। মুরগির দেহ গরম রাখতে সঠিক পরিমাণে কার্বোহাইড্রেটসমৃদ্ধ খাবার যেমন শস্য জাতীয় খাদ্য দিতে হবে।
- পানির উষ্ণতা: শীতকালে পানির তাপমাত্রা অনেক কমে যায়, যা মুরগির পান করার আগ্রহ কমিয়ে দেয়। তাই পানির তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পানি হিটিং সিস্টেম বা গরম পানির ব্যবস্থা করা দরকার।
- পানির ট্যাংকের সঠিক ব্যবহার: খামারে পানির ট্যাংক গরম রাখতে ট্যাংকগুলোকে রোদে রাখা যেতে পারে বা ইলেকট্রিক্যাল হিটার ব্যবহার করে পানির উষ্ণতা বজায় রাখা সম্ভব।
আশ্রয়স্থলের উন্নতি
শীতকালে মুরগির খাঁচা বা আশ্রয়স্থল যথাযথভাবে প্রস্তুত করতে হবে যেন তারা ঠান্ডা থেকে রক্ষা পায়। মুরগির আশ্রয়স্থলকে নিরাপদ ও উষ্ণ রাখার জন্য নিচের পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করা উচিত:
- আশ্রয়স্থলের আকার ও বিন্যাস: খামারে মুরগির বসবাসের জন্য উপযুক্ত আকারের স্থান নির্ধারণ করা উচিত, যাতে তারা যথেষ্ট স্থান পায় এবং শরীরের তাপ সংরক্ষণ করতে পারে।
- বিছানা বা লিটার: খামারে শুকনো ও উষ্ণ বিছানা রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। খড়, ধানের তুষ, কাঠের গুঁড়ি ইত্যাদি ব্যবহার করে বিছানা প্রস্তুত করা যায়। নিয়মিত লিটার পরিবর্তন করে তা শুকনো রাখতে হবে।
- ছিদ্র ও ফাটল বন্ধ করা: মুরগির আশ্রয়স্থলে থাকা যেকোনো ফাটল বা ছিদ্র দিয়ে শীতল বাতাস ঢোকার সম্ভাবনা থাকে। তাই সব ছিদ্র বন্ধ করতে হবে এবং আশ্রয়স্থলের দরজা, জানালা শক্তভাবে আটকানো নিশ্চিত করতে হবে।
আলো ও প্রাকৃতিক আলো সরবরাহ
শীতকালে দিন ছোট হয় এবং সূর্যের আলো কম পাওয়া যায়, যা মুরগির উৎপাদনশীলতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আলো মুরগির ডিম উৎপাদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, তাই শীতকালে কৃত্রিম আলো ব্যবহার করে এটি পূরণ করা সম্ভব।
- কৃত্রিম আলো: খামারে দিনে ১৪-১৬ ঘণ্টা কৃত্রিম আলো সরবরাহ করতে হবে। ইনকিউবেটরে এলইডি বা ইনফ্রারেড লাইট ব্যবহার করে আলো সরবরাহের সময় বাড়ানো উচিত।
- আলোর তীব্রতা: খামারের প্রতিটি অংশে আলোর তীব্রতা সমানভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে, যাতে সব মুরগি পর্যাপ্ত আলো পায়। আলোর তীব্রতা ২০-৩০ লাক্স হতে হবে।
মুরগির রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা
শীতকালে মুরগির মধ্যে নানা ধরনের রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়, বিশেষ করে শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা, কোল্ড স্ট্রেস এবং অন্যান্য শীতকালীন রোগ। তাই রোগ প্রতিরোধে খামারে নিচের ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি:
- টিকা ও ওষুধ: মুরগির নিয়মিত টিকা নিশ্চিত করতে হবে, বিশেষ করে শীতকালের আগে। খামারে এন্টিবায়োটিক এবং অ্যান্টি-ভাইরাল ওষুধের ব্যবস্থা রাখতে হবে। শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা এড়াতে ওষুধ প্রয়োগ করা যেতে পারে।
- পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা: খামারে প্রতিদিনের পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। খাঁচা, পানি ও খাদ্যের পাত্র, আশ্রয়স্থল নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে, যেন মুরগির সংক্রমণ না হয়।
- আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ: শীতকালে খামারের ভিতরে আর্দ্রতা কমে গেলে তা মুরগির শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা তৈরি করতে পারে। তাই ভিতরে পর্যাপ্ত আর্দ্রতা বজায় রাখতে বাতাসের চলাচল ঠিক রাখা এবং হিউমিডিফায়ার ব্যবহার করা যেতে পারে।
সঠিক ব্যবস্থাপনা ও নজরদারি
মুরগির সঠিক যত্ন নিতে হলে নিয়মিত নজরদারি ও ব্যবস্থাপনা করা উচিত। শীতকালে মুরগির স্বাভাবিক আচরণ এবং শারীরিক অবস্থার ওপর খেয়াল রাখা আবশ্যক।
- নিয়মিত পর্যবেক্ষণ: খামারে নিয়মিতভাবে মুরগিদের আচরণ পর্যবেক্ষণ করতে হবে। তারা ঠিকমতো খাদ্যগ্রহণ করছে কিনা, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে কিনা, বা কোনো রোগের লক্ষণ দেখা দিচ্ছে কিনা সেদিকে খেয়াল রাখা প্রয়োজন।
- আচরণগত পরিবর্তন: মুরগির মধ্যে শীতের প্রভাবের কারণে কোনো ধরনের আচরণগত পরিবর্তন দেখা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নিতে হবে। যেমন, খাদ্য খাওয়ার প্রবণতা কমে গেলে খাদ্যের মান উন্নত করতে হবে।
- বিশেষ ব্যবস্থা: শীতের তীব্রতা বাড়লে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যেমন, অতিরিক্ত গরম বাতাস সরবরাহ করা, খামারের ভিতরে হিটার বসানো এবং বেশি পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাদ্য সরবরাহ করা।
উপসংহার
শীতকালে মুরগির সঠিক যত্ন নেওয়া একটি বড় চ্যালেঞ্জ, তবে সঠিক ব্যবস্থাপনা ও নিয়মিত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তা সফলভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব। খামারের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, সঠিক খাদ্য ও পানির ব্যবস্থা, আশ্রয়স্থলের উন্নতি এবং রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিশ্চিত করলে শীতকালে মুরগির স্বাস্থ্য ভালো থাকে এবং উৎপাদনশীলতা বজায় থাকে। তাই, শীতকালে মুরগির যত্নে খামারিরা একটু বেশি সচেতন ও সঠিক পদক্ষেপ নিলে মুরগির উৎপাদন এবং সুস্থতা বজায় থাকবে।
