ডিম ফুটানোর মেশিন-ইনকিউবেটর

শীতকালে মুরগির খামারে করনীয় । মুরগি পালন পদ্ধতি

শীতকালে মুরগির খামারে বিশেষ কিছু করণীয় রয়েছে যা সঠিকভাবে পালন করা অত্যন্ত জরুরি। শীত মৌসুমে ঠাণ্ডা পরিবেশ মুরগির স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে এবং সঠিক ব্যবস্থাপনা না নিলে খামারের উৎপাদনশীলতা ব্যাপকভাবে কমে যেতে পারে। শীতকালে মুরগির খামারে করণীয় বিভিন্ন পদক্ষেপ সম্পর্কে বিস্তারিত জানানো হচ্ছে যা খামারের উৎপাদন বজায় রাখতে সহায়ক হবে।

১. আবাসস্থল প্রস্তুতি ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ

শীতের সময় মুরগির ঘরকে উষ্ণ রাখা সবচেয়ে জরুরি কাজ। মুরগির শরীরের তাপমাত্রা ঠিক রাখতে উপযুক্ত তাপমাত্রা বজায় রাখা প্রয়োজন। এজন্য খামারে কয়েকটি পদক্ষেপ নিতে পারেন:

  • ইনফ্রারেড হিটার বা বাল্ব

    : মুরগির ঘরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে ইনফ্রারেড হিটার ব্যবহার করা একটি ভালো পদ্ধতি। এটি মুরগির শরীরের তাপমাত্রা বজায় রাখতে সহায়ক। এই বাল্বগুলো সরাসরি তাপ দেয়, যা মুরগির শরীরকে উষ্ণ রাখে।

  • ঘর ঢেকে রাখা: শীতকালে মুরগির ঘরের জানালা ও দরজা ভালোভাবে ঢেকে রাখতে হবে যাতে ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকতে না পারে। ছিদ্র বা ফাঁক থাকলে তা বন্ধ করে ফেলতে হবে।
  • ঘরের ভিতরে মোটা স্তর: মুরগির ঘরের মেঝেতে মোটা খড়ের স্তর দেয়া যেতে পারে। খড় তাপ ধরে রাখে এবং ঠাণ্ডা থেকে মুরগিকে রক্ষা করে।
  • ঘরের আকার নির্ধারণ: খামারের ঘর ছোট হলে তা তাড়াতাড়ি উষ্ণ হয় এবং তাপ ধরে রাখে। তাই ঘর ছোট এবং ঘন করে তৈরি করতে হবে।
  • Play

২. খাদ্য ব্যবস্থাপনা

শীতকালে মুরগির খাদ্য গ্রহণের মাত্রা বাড়ে কারণ তাদের শরীর উষ্ণ রাখতে অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োজন। সঠিক খাদ্য পরিকল্পনা ও পুষ্টি নিশ্চিত করতে:

  • উচ্চ ক্যালোরিযুক্ত খাদ্য: শীতকালে মুরগির জন্য উচ্চ ক্যালোরিযুক্ত খাবার দেয়া উচিত। যেমন ভুট্টা, সয়াবিন, বা চালের গুঁড়া। এই খাবারগুলো মুরগির শরীরে তাপ উৎপাদন করতে সাহায্য করে।
  • প্রোটিন সমৃদ্ধ খাদ্য: মুরগির ডিম উৎপাদন এবং ওজন বাড়াতে প্রোটিনের প্রয়োজন। তাই শীতকালে খাদ্য তালিকায় প্রোটিনসমৃদ্ধ উপকরণ, যেমন মাছের গুঁড়া, সয়াবিনের গুঁড়া অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
  • পর্যাপ্ত পানি: শীতকালে মুরগির খাওয়ার পাশাপাশি পানি পান নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। পানি শীতল হলে মুরগি কম পানি পান করতে পারে, তাই খামারে হালকা উষ্ণ পানি সরবরাহ করতে হবে।

৩. রোগ প্রতিরোধ এবং চিকিৎসা

শীতকালে মুরগির রোগবালাই বাড়তে পারে। ঠাণ্ডা ও আর্দ্রতা মুরগির বিভিন্ন রোগের কারণ হতে পারে। এজন্য সঠিক প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।

  • রেস্পিরেটরি রোগ: শীতকালে মুরগির শ্বাসকষ্টজনিত রোগের ঝুঁকি বেশি থাকে। ঠাণ্ডা বাতাসে মুরগি দ্রুত শ্বাসকষ্টে ভুগতে পারে, তাই ঘরের তাপমাত্রা উষ্ণ রাখা এবং পর্যাপ্ত বায়ুচলাচল নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
  • ব্রোকাইটিস প্রতিরোধ: শীতকালে ব্রোকাইটিসের সমস্যা বেড়ে যায়। তাই মুরগিকে সময়মত টিকা দেয়া এবং রোগের লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা জরুরি।
  • পায়ে আঘাত ও ফ্রস্টবাইট: শীতকালে মুরগির পায়ে ফ্রস্টবাইট হতে পারে। তাই খামারের মেঝেতে পর্যাপ্ত খড় দিয়ে পায়ের আঘাত ও ফ্রস্টবাইট থেকে রক্ষা করতে হবে।

৪. আলো ও দিনের দৈর্ঘ্য

শীতকালে দিনের দৈর্ঘ্য কম থাকে, যা মুরগির প্রজনন ও ডিম উৎপাদনে প্রভাব ফেলে। তাই খামারে কৃত্রিম আলো ব্যবহার করে দিনের আলোর সময় বাড়ানো প্রয়োজন।

  • অতিরিক্ত আলো ব্যবহার: দিনে ১৪-১৬ ঘণ্টা কৃত্রিম আলো দিলে মুরগির ডিম উৎপাদন ঠিক থাকে। এলইডি বা ইনকান্ডেসেন্ট বাল্ব ব্যবহার করে এই আলোর সময় নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
  • প্রাকৃতিক আলোর সদ্ব্যবহার: দিনের সময় যতটুকু প্রাকৃতিক আলো পাওয়া যায়, তা মুরগির ঘরে প্রবেশ করানোর ব্যবস্থা করতে হবে। প্রাকৃতিক আলো মুরগির জন্য স্বাস্থ্যকর এবং উৎপাদনশীলতা বাড়ায়।

৫. পরিচ্ছন্নতা ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ

শীতকালে খামারের আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঠাণ্ডা এবং স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে মুরগির রোগবালাই বাড়তে পারে। সেজন্য:

  • পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা: খামারের মেঝে এবং ঘরের চারপাশ পরিষ্কার রাখতে হবে। নিয়মিত খামার পরিষ্কার করলে রোগজীবাণু কমে এবং মুরগির স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়।
  • আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ: খামারের আর্দ্রতা ঠিক রাখতে ভেন্টিলেশন সিস্টেমের ব্যবস্থা করতে হবে। অতিরিক্ত আর্দ্রতা মুরগির শ্বাসকষ্ট এবং অন্যান্য রোগের কারণ হতে পারে। এজন্য ঘরে ভালোভাবে বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা থাকতে হবে।

৬. ডিম উৎপাদন এবং প্রজনন ব্যবস্থা

শীতকালে ডিম উৎপাদনের হার কমে যেতে পারে। মুরগির প্রজনন কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনা করতে কিছু করণীয়:

  • ইনকিউবেটরের ব্যবহার: শীতকালে ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানোর জন্য ইনকিউবেটরের ব্যবহার করতে হবে। ইনকিউবেটরের তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
  • ডিম সংগ্রহ: শীতকালে ডিম দ্রুত শীতল হয়ে যায়। তাই ডিম উৎপাদনের পর দ্রুত সংগ্রহ করে নিরাপদ স্থানে রাখতে হবে।
  • প্রজনন ব্যবস্থাপনা: মুরগির প্রজনন কার্যক্রম শীতকালে কমে যেতে পারে। মুরগির জন্য উপযুক্ত তাপমাত্রা এবং পর্যাপ্ত আলো নিশ্চিত করতে পারলে প্রজনন কার্যক্রম স্বাভাবিক থাকবে।

৭. বিশেষ ব্যবস্থা

শীতকালে মুরগির খামারে আরও কিছু বিশেষ ব্যবস্থা নিতে পারেন:

  • পোষা মুরগির জন্য বিশেষ খাদ্য: মুরগির জন্য বাড়তি খাদ্য সরবরাহ করতে হবে, বিশেষ করে যারা ডিম দেয় বা বাচ্চা ফুটানোর জন্য ব্যবহৃত হয়।
  • মুরগির শরীরের পরীক্ষা: নিয়মিত মুরগির শরীর পরীক্ষা করে তাদের স্বাস্থ্যের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
  • ঠাণ্ডা সহনশীল জাতের মুরগি নির্বাচন: খামারে এমন জাতের মুরগি পালন করা উচিত যারা ঠাণ্ডা সহ্য করতে সক্ষম।

উপসংহার

শীতকালে মুরগির খামারের সঠিক ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত জরুরি। তাপমাত্রা, খাদ্য, স্বাস্থ্য, আলো এবং পরিচ্ছন্নতা বজায় রেখে শীতের সময় মুরগির খামারের উৎপাদনশীলতা নিশ্চিত করা যায়। সঠিক পরিকল্পনা ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করলে শীতের কঠিন সময়েও খামার কার্যকরভাবে চালানো সম্ভব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *